চোখ ভালো রাখার এবং চোখের সমস্যা প্রতিকারের কিছু কার্যকরী উপায়
শারীরিক যত্নের এক অবশ্যম্ভাবী এবং উপকারী যত্ন হল চোখের যত্ন। চোঁখের মত মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হল পৃথিবীটা সেই মানুষটির জন্য নরকে পরিণত হয়ে ওঠা। আজকের এই আর্টিকেলে চোখ ভালো রাখার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে
স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার খাওয়া :
এটি খুবই পরিচিত একটি বিষয়। আসলেই এর কোনো বিকল্প নেই। আগে স্বাস্থ্যকর খাবার তারপর নিজের শরীর ঠিক রাখা। মোটামুটি স্বাস্থ্য ঠিক রাখার প্রসেসটি শুরু হয় সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়েই। একটিকে ছাড়া অপরটি অসম্ভব। শরীরের জন্য তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই প্রয়োজন।যাদেরকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বলা হয়। এই এসিড সমৃদ্ধ বিভিন্ন তেলযুক্ত মাছ যেমন স্যালমন,টুনা এবং হালিবুট ইত্যাদি খাওয়া প্রয়োজন। চোখ ভালো রাখার এটি অন্যতম কার্যকর একটি উপায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা আসলে পুরো শরীরের সার্বিক ভালোর জন্যই দরকার। ঠিক তেমনি চোখ এর বাইরে নয়। কারণ ওজন নিয়ন্ত্রণে না থাকলে পরোক্ষভাবে চোখেরই ক্ষতি। কারণ অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিসের ঝুকি বাড়ায় এবং ডায়াবেটিস দীর্ঘমেয়াদে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দেয়। তাই চোখ ভালো রাখার জন্য ডায়াবেটিস এর উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা অবশ্যম্ভাবী।
রেগুলার এক্সারসাইজ:
এটি খুবই কমন একটি হেলথ এডভাইজ। ডাক্তার এবং যে কেউই এই হেলথ এডভাইজটি দিয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থেই এর বিকল্প নেই। কারণ একজন মানুষের ভাল স্বাস্থ্য এবং রোগমুক্তির জন্য হাই কোলেস্টেরল এবং হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখা একধরনের ফরজ দায়িত্ব । কারণ প্রায় অধিকাংশ রোগের সূচনাটা হয় এসব সহজাত রোগের মধ্য দিয়েই। অন্তত উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলেও ব্যায়াম বাধ্যতামূলক একটি হাতিয়ার। এ সমস্ত কমন কিছু শারীরিক সমস্যা চোখেও প্রভাব ফেলে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায় এবং একই সাথে ডায়াবেটিস চোখের দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব ফেলে।
চোখে সানগ্লাস পরা:
শখের বশে বা স্টাইলের জন্য হোক চোখে সানগ্লাস পরা উভয়ের জন্যই ভালো। কারণ চোখকে সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। চোখের ছানি রিলেটেড রুগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চোখের ছানির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই কাজ করে সূর্যের রশ্মির মধ্যে থাকা অতি বেগুনি রশ্মি। চোখের চশমা সেই অতি বেগুনি রশ্মির প্রায় ৯৯ থেকে ১০০ ভাগই কমিয়ে দেয়। অতি বেগুনি রশ্মির মধ্যে রয়েছে ইউভি-এ এবং ইউভি-বি রশ্মি। এই দুই রশ্মিকেই পুরোপুরি ব্লক আউট করে দেয় চোখের চশমা। সেজন্য সূর্যের আলো থেকে খুব ভালো একটি প্রোটেকশন লেয়ার হিসেবে কাজ করে চশমা।
বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ যদি কেউ একজন ফ্যাক্টরি অথবা কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজ করে। তখন চোখের চশমার পরিবর্তে প্রটেক্টিভ আই ওয়্যার পরতে হয়। যেহেতু এটি শরীরের জন্য অতি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় চোখ তাই এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা মানেই নিজের জন্য বড় ধরনের অ্যাকসিডেন্ট ডেকে নিয়ে আসা। রেপরাউন্ড লেন্সের সানগ্লাস পরা অধিক বাঞ্চনীয়। কারণ এটি চোখকে প্রায় সব দিক থেকেই সুরক্ষা দেয়। পোলারাইজড ল্যান্সও ব্যবহার করা যায় কিন্তু এটি শুধু একদিক থেকেই সুরক্ষা দেয়। হকি, রেক্যাটবল এবং ল্যাক্রোস ইত্যাদি খেলাধুলা চোখের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই চোখের নিরাপত্তার জন্য পলিকার্বনেটের তৈরি প্রোটেক্টিভ স্পোর্টস গগলস পরা উচিত। এতে করে চোখের আরেকটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা শিল্ডিং হয়ে যায়।
ধূমপান পরিত্যাগ :
অন্য অনেক রোগের কারণ এবং সাময়িক সুখ নামের এই নেশাটি মানুষের জীবনের অধিকাংশ জিনিসই শেষ করে দেয়। তাছাড়া ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ ত আছেই। কিন্তু চোখের ক্ষেত্রে এটি খুব প্রাণঘাতী এবং অন্য রকমের প্রভাব ফেলে। প্রথমে এটি চোখের অপটিক নার্ভ গুলোর কার্যক্ষমতা শেষ করে দেয় এবং ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন নামক রোগের উদ্ভব ঘটায়। চোখের প্রাণ হলো অপটিক নার্ভ। কাজেই এর ক্ষতির অর্থ হল নিজের চোখকে নিজেই ধ্বংস করে দেওয়া। তাই কষ্ট হলেও ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা জরুরি। তাছাড়া চোখের ছানি পড়ার মত সমস্যাও ধূমপানের কারণে হয়। এই বদ অভ্যাস একজন মানুষ যত ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ততই ভালো। হয়তো সবাই একবারে পারে না।কিন্তু যারা চেষ্টা চলমান রাখতে পারে তারা একসময় এই অভ্যাসটি থেকে মুক্তি পায়। সেই সাথে অন্য অনেক শারীরিক সমস্যার সাথে চোখের সমস্যা থেকেও মুক্তি পেয়ে যায়। নিজের ভালো সবার বুঝা উচিত। আর নিজের ভালোর জন্যই সিগারেটকে না বলতে হবে।
পরিবারের কারও চোখের সমস্যা আছে কিনা জানা:
কিছু চোখের সমস্যা আছে বংশগতিয়। তাই পরিবারের কারও আগে চোখের সমস্যা আছে কিনা তা জানা খুবই জরুরি। যদি চোখের সমস্যার ক্ষেত্রে কেউ ঝুঁকিতে থাকে তাহলে সে অন্তত কারণটা জানতে পারবে।
রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানা :
মানুষের বার্ধক্য জনিত চোখের রোগও ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শরীর চেক আপ করানোই একমাত্র মাধ্যম। এতে করে লাভ হল চেক আপে ধরা পড়া শরীরের বিভিন্ন অসঙ্গতি মোকাবিলা করা যা পরবর্তীতে চোখের সমস্যা ঘটাতে পারে। শুধুমাত্র কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রিস্ক ফ্যাক্টরকে মোকাবিলা করা যায়।
আই কনটাক্ট ল্যান্স ব্যবহার করলে চোখে ইনফেকশন হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া:
কন্ট্যাক্ট ল্যান্স ব্যবহারের আগে ভালো করে হাত পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া এসব কন্ট্যাক্ট ল্যান্স ব্যবহারের নীতিমালাও ভালোভাবে জানা থাকতে হবে সেই সাথে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং সময় অনুযায়ী এসব রিপ্লেস করতে হবে।
চোখকে বিশ্রাম দেওয়া :
চোখের ভালোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটি। বেশিরভাগ চোখের সমস্যা এই কারণেই হয়। আমরা লাগাতার কাজ করতে থাকি কিন্তু ভুলে যাই যার কারণে দেখে কাজ করতে পারছি তারও একটা বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশেষ করে এই সমস্যাটি তাদেরই হয় যারা একটানা কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করে। একে তো কম্পিউটার থেকে বের হওয়া গামা রশ্মির উৎপাত। তার উপর চোখকে কোনো বিশ্রাম না দিয়ে লাগাতার কাজ। এসব লোকেদের চোখে কম বয়স থেকেই হাই পাওয়ারের চশমা লাগাতে হয়। এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য একটি নিয়ম করা যেতে পারে আর তা হল ২০-২০-২০। অর্থাৎ যদি ২০ মিনিট কম্পিউটার দেখে কেউ তাহলে পরবর্তী ২০ মিনিট কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে থেকে উঠে গিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকানো। যার ফলে চোখের ক্লান্তি ভাবটা দূর হয়ে নতুন করে সতেজতা ফিরে আসবে। আর চোখের জন্যও এটি ফলদায়ক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা যেসব সমস্যার কারন হতে পারে তা হল
- চোখ টনটন করা বা চোখে ব্যথা করা
- চোখে ঝাপসা দেখা
- একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে কোন কিছু দেখতে সমস্যা হওয়া
- শুষ্ক চোখ
- মাথা ব্যাথা
- গলা কাঁধ এবং পেছনে ব্যথা করা ইত্যাদি
এসব সমস্যা থেকে চোখকে মুক্ত করতে :-
- ডাক্তারের প্রেসক্রাইপ্ট করা চোখের ল্যান্সটা আপ টু ডেট আছে কিনা তা চেক করে নিতে হবে একইসাথে কম্পিউটারের স্ক্রিনের সাথে মানানসই কিনা তাও চেক করতে হবে
- যদি চোখের ব্যথা না কমে তাহলে কম্পিউটারের স্ক্রিন গ্লাসের ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে
- চোখকে সবসময় কম্পিউটার স্ক্রিনের উপরে রাখতে হবে বা উপর থেকে দেখে আসতে হবে। এটি একটি চমৎকার কৌশল।
- কম্পিউটার স্ক্রিনের আলোকে গ্লেয়ার মুক্ত করতে হবে বা যদি প্রয়োজন হয় এন্টি গ্লেয়ার স্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে কিছুক্ষণ পর চোখ ঝাপসা দেখবে।
- চোখ যদি একদম শুষ্ক থাকে তাহলে যতটা সম্ভব চোখ পিটপিট করাতে হবে বা কৃত্রিম চোখের পানিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
চোখের সমস্যা প্রতিকারের জন্য কিছু পরীক্ষা:
সাধারণত চেকআপের সময় একজন মানুষের ভিশন টেস্ট হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে শিশুদের স্কুলেই এটি করা হয়ে থাকে যার নাম ভিশন স্ক্রিনিং। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এর চেয়েও দীর্ঘময়াদি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
এসব পরীক্ষা খুবই গুরত্বপূর্ণ কারণ আই স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে কোনো একটা সমস্যার শুরুতেই এটি ধরে ফেলা যায় যাতে পরবর্তীতে এটি বড় রূপ ধরতে না পারে। কারণ এমন অনেক চোখের রোগ আছে যেগুলোর কোনো সতর্কতামূলক সাইন থাকে না। এগুলো নিরবেই চোখকে শেষ করে দেয়। তাই ভিশন চেকআপ টা খুবই জরুরি।
চোখের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার আরেকটি উপায় হলো পেরিফেরাল ভিজুয়্যাল আই টেস্ট। সাধারণত ২০ ফিট দূরত্বে কিছু অক্ষর রেখে এগুলোকে পড়তে বলা হয়। যদি ঠিকঠাকভাবে পড়তে পারে তাহলে দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই পেরিফেরাল টেস্ট এ ফেইল করলে গ্লুকোমার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
তাছাড়া টনোমেট্রি নামে আরেক ধরনের আই টেস্ট আছে যার মাধ্যমে চোখের অভ্যন্তরে চাপ পরিমাপ করা হয়। তাছাড়া পরীক্ষাটি গ্লুকোমা নির্ণয়েও সাহায্য করে।
চোখের ডিলেশন করাও মোটামুটি গুরুত্বপুর্ণ। একটা বিশেষ ধরনের ড্রপের মাধ্যমে এটি করা হয়। যার ফলে চোখের পিওপিল সামান্য সম্প্রসারিত হয় এবং চোখে বেশি আলো প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসকরা সাধারণত একটি বিশেষ ম্যাগনিফাইং গ্লাস পড়ার পরামর্শ দেয়। এর কারণে একটি ক্লিয়ার ভিউ পায় চোখ।
চোখের প্রতিসরণের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলে বিভিন্ন ধরনের লেন্স এর মাধ্যমে বিভিন্ন দূরত্বে পরীক্ষা করা হয়,কোনটা কার জন্য সুইটেবল সেটা ধরে নিয়ে চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন। এসব ক্ষেত্রে অবহেলা করা মোটেও উচিৎ নয়। অনেক সময় অনেকেই ডাক্তারদের পরামর্শে দেওয়া চশমা কোন কারণ ছাড়াই ব্যাবহার করা বন্ধ করে দেন। চোখের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গের ক্ষেত্রে এসব নিজের ডাক্তারি না দেখানোই ভালো।
কিছু ব্যাপারে জাতিগত সমস্যা আছে।আফ্রিকান আমেরিকানদের ক্ষেত্রে চোখের পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিয়ে নেওয়া ভাল না হলে গ্লুকোমার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে তারা। কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে তার প্রত্যেক বছরই চেক আপ করা উচিৎ। কারণ ডায়াবেটিস থাকার অর্থ হল দীর্ঘমেয়াদে শরীরের মধ্যে অন্য রোগও বাসা বাঁধা। তাই স্বাস্থ্য সম্পর্কে ডায়াবেটিস রোগীদের সবসময়ই সতর্ক থাকা উচিৎ।