অ্যাপল পার্ক - 🍏দুনিয়ার বিস্ময়কর স্থাপত্যের এক চরম বিস্ময়
পৃথিবীতে প্রত্যেক স্থাপনারই একটি নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী আছে। তবে সব স্থাপনাই বিস্ময়ের কারণ হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনি একটি ব্যতিক্রমী এবং রীতিমতো চমকে ওঠার মতো সুন্দর এক স্থাপত্য হল অ্যাপল পার্ক। বিশ্বব্যাপী টেকনোলজির দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়া টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের অফিসটিই অ্যাপল পার্ক নামে পরিচিত।
আপনাদেরকে জানানো হবে যেখান থেকে পুরো বিশ্বজোড়া কোম্পানিটির বিস্তৃতি এবং প্রসারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেই অ্যাপল পার্কের কিছু চমকপ্রদ তথ্য। তাহলে শুরু করা যাক।
অ্যাপল পার্ক |
আপনি ওপরের ছবিতে যেটি দেখতে পেয়েছেন এটি এলিয়েনদের কোন স্পেসশিপ কিংবা সায়েন্স ফিকশন মুভির কোন এনিমেশন সিন নয়। এটি হল স্টিভ জবস বা অ্যাপলের সেই রত্ন যেটি কেউ কখনো কিনতে পারবে না।
এখন জানা যাক এই ফ্যাসিনেটিং স্থাপনাটি তৈরি করতে অ্যাপলের কত খরচ হয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হল অ্যাপল পার্ক তৈরি করতে খরচ হওয়ার কথা ছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ খরচের পরিমাণ ছিল ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে কি দুনিয়ার সবচেয়ে হাইটেক বিজনেস কোম্পানির ক্যালকুলেশনে এত বড় ভুল। ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং এবং স্বাভাবিকভাবে খুব অস্বাভাবিক মনে হলেও আসুন দেখি কি কি রয়েছে অ্যাপলের এই অসাম অ্যাপল পার্কে।
অ্যাপলের এই হেডকোয়ার্টার চল্লিশটি ফুটবল মাঠের সমান। যাকে আপনার একটি হাইটেক ফিউচারিস্টিক সিটিও মনে হতে পারে। কারণ জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই এখানে বিদ্যমান। যেমন খাবারের জন্য ক্যাফেটেরিয়া, সুস্বাস্থ্যের জন্য জিম এবং মেডিকেল ইমার্জেন্সি ইত্যাদি। তবে হেডকোয়ার্টারটি মাটির উপরে নয়।
তাই বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতির আশংকাও তেমন একটা নেই। এমনকি এত বিশাল একটা হেডকোয়ার্টার সম্পূর্ণ নবায়নযোগ্য শক্তি তথা সোলার সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত। পুরো বছরে কখনো কোনো এসি বা হিটারের প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। কিন্তু কিভাবে ?? আজকে তারই রহস্য উন্মোচন করা হবে।
এটি ছিল স্টিভ জবসের স্বপ্ন, যেটি তিনি ২০১১ সালে সিটি কাউন্সিলের সামনে বলেছিলেন। কিন্তু এই স্বপ্ন তার মধ্যে ছিল ২০০৪ সাল থেকেই। মূলত তিনি তার কর্মীদের এমন একটি পরিবেশ দিতে চাচ্ছিলেন যেখানে হেডকোয়ার্টার তথা বিল্ডিং এবং পরিবেশের মধ্যে কোন ক্রস লাইন থাকবে না।
নিজের তৈরি করা জিনিয়াস প্রোডাক্টগুলোর মতোই তিনি এমন একটি স্থাপত্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেটি আগামী দশক বা তারও বেশি সময়ের জন্য নিউ বর্ন কোম্পানিগুলোর জন্য উৎসাহ হিসেবে কাজ করবে। জবস সেটা করেও দেখিয়েছেন তার জীবনের শেষ কিছু সময়ে। তবে তার স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবিক রূপ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
অক্টোবর ২০১১ সালে অ্যাপলকে টিম কুকের কাছে হস্তান্তর করে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। অবাক করা বিষয় হল জবস অ্যাপল পার্কের নির্মাণ ব্যয় ৫০ কোটি ডলার ধরলেও এর আট বছর পর নির্মাণ ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলারে।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই অর্থ ২০০৮ সালে অ্যাপলের ক্যাশ রিজার্ভের মাত্র ২% ছিল এবং বর্তমানে এই অর্থ তাদের কাছে অতি নগন্য। বর্তমানে তাদের ব্যবসা ২.০৮ ট্রিলিয়ন ডলারের এবং সেই সাথে তারা প্রায় পৃথিবীর সকল বিলিয়নারদের পেছনে ফেলে দিয়েছে।
অ্যাপলের এই ক্যাম্পাস নির্মাণের জায়গার বিষয়ে বলতে গেলে অ্যাপল প্রথমে জায়গাটি কিনে তাদের নিজেদেরকে আড়াল করে অর্থাৎ তারা অন্যান্য প্রতিযোগীদের থেকে নিজেদের লুকিয়ে রেখে এই জায়গাটি কিনেছিল ১৬০ মিলিয়ন ডলারে।
১৭৫ একরের এই জমিটি অ্যাপল ২০০৮ সালের আগেই কিনে রেখেছিল তবে এখানে তারা অ্যাপল পার্ক নির্মাণের পারমিশন পায় ২০১৩ সালে। অ্যাপল পার্ক নামক এই কিংবদন্তি নির্মাণশৈলীর দায়িত্বে ছিলেন দুনিয়া জোড়া বিখ্যাত আর্কিটেক্ট নরম্যায়ান ফস্টার।
২০১৭ সালে অ্যাপলের ওপেনিং-এর পর দুনিয়া জোড়া শুধু অ্যাপল পার্কের গুণগান চলছিল। অনেকে অ্যাপল পার্ককে রিং এবং স্পেসশিপ নিক নেমও দিয়ে থাকে। গোলাকার বিল্ডিংটিতে ২.৮ স্কয়ার ফিটের অফিস স্প্যাস আছে যেখানে অনায়াসেই ১২০০০ কর্মী কাজ করতে পারে। অ্যাপল পার্ক তিন হাজার গ্লাস প্যানেল দিয়ে বেষ্টিত।
এই ক্যাম্পাসের বাইরে এবং ভিতরে দু'পাশেই গ্যালারির মত জায়গা রাখা হয়েছে যাতে কর্মচারীরা বের হতে বা প্রবেশ করতে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। তবে অ্যাপল পার্ক কিন্তু শুধুমাত্র এই বিল্ডিং এর জন্যই বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত না।
এখানে তিন লাখ স্কয়ার ফিটের দুটি রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট বিল্ডিংও রয়েছে যেখানে দুহাজার কর্মী একসাথে কাজ করে। সেই সাথে অ্যাপল তার কর্মচারীদের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বানিয়েছে এক লাখ স্কয়ার ফিটের একটি ওয়েলন্যাস সেন্টার।
যেখানে ইয়োগা থেকে শুরু করে সব ধরনের লেটেস্ট ফিটনেস মেশিন রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে একটি ভিজিটিং বিল্ডিং, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এবং অডিটোরিয়াম।
অ্যাপলের বিল্ডিংটি কিন্তু মাটির উপর দাঁড়ানো নয়। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে অ্যাপল কি তাহলে বার হাজার কর্মী নিয়ে হাওয়ায় ভেসে আছে ? উত্তর হবে, না।
এই বিল্ডিংটি বানানো হয়েছে বেজ আইসোলেশন টেকনোলজি দিয়ে। বিল্ডিংটি ৬৯২ টি স্টেইনল্যাস স্টিল প্ল্যাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যা কিনা যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় ৪ ফিট পর্যন্ত কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই যে কোন ডিরেকশনে মুভ করতে পারে।
শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তি এতটাই কার্যকারী যে আট এর বেশি ম্যাগনেটিউট ঝটকাকেও সামলে নিতে পারে। অ্যাপলের এই বিখ্যাত বিল্ডিংটিকে সুরক্ষিত রাখতে স্টিভ জবস প্রযুক্তিটি নিজেই পছন্দ করেছিলেন।
তবে জাপানের এই প্রযুক্তিটি অ্যাপলের শুধু মেইন বিল্ডিং না বরং অ্যাপল পার্কের অডিটোরিয়াম যাকে স্টিভ জবস থিয়েটার বলা হয় সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে। এই অডিটোরিয়ামটি ১৫৫ ফিট জায়গার উপরে মেটালিক কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
এখানে একসাথে ১০০০ লোক ধারণ করার পরেও পুরো জায়গাটাকে আপনার খালি বলেই মনে হবে। আসলে থিয়েটারের আসল রূপ হল গ্রাউন্ড ফ্লোরে, উপরে শুধুই কাঁচের দেয়াল। সিঁড়ি বা লিফট ব্যবহার করে নিচে যাওয়ার পরে প্রথমেই যেটা দেখা যায় সেটা হলো স্টিভ জবস থিয়েটার।
যেখানে এক হাজার লোক একসাথে বসতে পারে। এখানকার প্রতিটি লেদার চেয়ারের দাম ১৪০০০ ডলার। অ্যাপল পার্কের প্রতিটি জিনিসই অনেক দামি। শুধুমাত্র পিজ্জা রাখার জন্যও তাদের আলাদা পিজ্জা বক্স আছে।
বেজ আইসোলেশন টেকনোলজি, ক্যাফেটেরিয়া, অডিটোরিয়াম এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং |
আসলে অ্যাপল পার্কের বিশেষত্বটা তার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আসলে এটা একটা পার্ক এবং একই সাথে কাজের জায়গা যেটি নয় হাজার গাছ দিয়ে আচ্ছাদিত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য Apricot, Olive, Cherry, Plum এবং Apple গাছও রয়েছে।
মূলত অ্যাপল পার্কে এত গাছ লাগানোর কারন ছিল এটি শুধু কাজের জায়গা নয় বরং একটি পরিবেশ বান্ধব পরিবেশে নিজেকে উপভোগ করার একটি অনন্য স্থান। আর এই অ্যাপল পার্কের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস অর্থাৎ সোলার প্যানেল।
অ্যাপলের এই রিং বিল্ডিংয়ের উপরে লাগানো হয়েছে ৭২ হাজার মেগাওয়াটের সোলার প্যানেল। এই সোলার প্যানেল দিয়েই পুরো ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। শুধু তাই নয় অ্যাপল তাদের প্রত্যেকটি প্রোডাক্টে রিনিউয়েবল এনার্জি ব্যবহার করে।
আসলে অ্যাপল পার্ককে এতটাই ন্যাচারাল করে তৈরি করা হয়েছে যে বছরের নয়মাসই এক্সট্রা কোন হিটিং বা কুলিং এর প্রয়োজন পড়ে না।
এই কাজকে আরো সহজ করে অ্যাপল বিল্ডিংয়ের ন্যাচারাল ভেন্টিলেশন সিস্টেম। তাপমাত্রা বাড়া বা কমার সাথে সাথে এখানকার অপটিমাম তাপমাত্রা অটোমেটিক সেট হয়ে যায়। কারণ এখানে বাইরের বাতাস সহজে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে এবং ভিতরেরটা বাইরে। মানে কর্মীদের সাথে সাথে এই বিল্ডিং নিজেও শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়।
বিল্ডিংটির তাপমাত্রার পার্থক্য সব সময় ২০° সেলসিয়াস থেকে ২৫° সেলসিয়াসের মধ্যেই থাকে। তাই বছরের নয় মাস জুড়ে কখনো এসি বা হিটার কোনটাই লাগে না।
অ্যাপল পার্কের ক্যাফেটেরিয়া এতই বড় যে এখানে চার হাজার লোক একসাথে ফুড এনজয় করতে পারে প্রচলিত কোন রেস্টুরেন্টের মত গ্লাসের মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে।
এছাড়াও এখানে রয়েছে ৩.২ কিলোমিটার রানিং পাথ, ১০০০ সাইকেল পার্কিং প্লট এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং। আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিংয়ে প্রায় ১৪০০০ গাড়ি পার্ক করা যায় যাতে বাইরের সৌন্দর্য নষ্ট না হয়। রয়েছে একটা ইয়োগা সেন্টার এবং দুইটি ফিটনেস সেন্টার।
এর সৌন্দর্য আরো বাড়ানোর জন্য রয়েছে রংধনুর মতো একটি স্থাপনা। এই রংধনুর কালার অ্যাপলের পুরনো লগোর মতই ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপর আসে অ্যাপলের ভিজিটিং সেন্টার। যেখানে আপনি আপনার আইপ্যাড দিয়ে অ্যাপল সেন্টারটির পূর্ণাঙ্গ একটি ভিউ নিতে পারবেন। তাছাড়া অ্যাপলের সব ধরনের লেটেস্ট প্রোডাক্ট ১০০০০ ফিটের এই এরিয়াতে পাওয়া যায়।
এত এত কিছুর পর এটাকে অ্যাপল সিটি বলাই যায়। তাহলে আপনারাই বলুন প্রথমে অ্যাপলের ঐ মিস ক্যালকুলেশন স্বাভাবিক নয় কি ? অ্যাপল পার্ক নিয়ে প্রশ্নটির উত্তর কমেন্টে দিয়ে যাবেন।