লোভনীয় স্বাদের আমের আচার যেভাবে তৈরি করবেন

বাঙালীর সেরা স্বাদের অভিজাত একটি রেসিপি হলো আমের আচারআমের আচার রেসিপি সম্বন্ধে অনেক ক্ষেত্রে দেশের অভিজাত শ্রেণির রেসিপিও এটিকে মনে করা হয়। গ্রীষ্মের সেই কচি আমের স্বাদে মসলা দিয়ে মাখানো আমের আচার রেসিপি বাঙালীর জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকে আপনাদের ধাপে ধাপে করে দেখানো হবে কিভাবে সেরা স্বাদের আমের আচার রেসিপি তৈরি করবেন। তাই ধৈর্য্য ধরে আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল। আশা রাখি স্পেশাল স্বাদের আমের আচার রেসিপি আপনি ঘরে বসেই বানাতে পারবেন।

আমের আচার রেসিপি তৈরির উপকরণসমূহ -

  • কাচা পাকা আম
  • সরিষার তেল
  • জিরা
  • শুকনো মরিচ
  • দাড়চিনি
  • সাদা এলাচ
  • কালো এলাচ
  • তেজপাতা
  • ধনিয়া
  • পাঁচফোড়ন 
  • রসুন কুঁচি
  • রসুন‌‌ বাটা
  • আদা‌ বাটা
  • মরিচের গুঁড়া
  • হলিদের গুঁড়া
  • লবণ
  • ভিনেগার
  • কালি জিরা

আমের আচার রেসিপি

ধাপ-১ : কাচা পাকা আম নেওয়া

আমের আচার যেহেতু করবেন তাই আম লাগবেই। তবে সে আম হতে হবে কাঁচা পাকা। দেখবেন বাসায় কচি আম নিয়ে এসে কয়েকদিন রাখার পর কিছু আম কাঁচা বা আবার কিছু পেকে যায়। এই আমগুলো দিয়েই আপনাকে আচারটা করতে হবে। প্রথমেই আমি ১৪ টি কাঁচা পাকা আম নিয়েছি। আপনারা নিচের ইমেজে দেখতে পাচ্ছেন। আমগুলোর চামড়া ছিলে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

আচারের জন্য কাঁচা পাকা আম
কাঁচা পাকা আমগুলোকে কেটে টুকরো করে নেওয়া

তারপর আমগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিবেন। অর্থাৎ আমের আঁটি সেপারেট করে নিবেন।

ধাপ-২: আমের আচারের মসলা প্রস্তুতি 

এবার একটা কড়াইয়ে এক কাপের একটু কম সরিষার তেল নিবেন (আচারটা সরিষার তেল দিয়েই তৈরি করতে হবে)। তারপর সরিষার তেলে হাফ টেবিল চামচ জিরা এড করবেন। তারপর কাঁচি দিয়ে কেটে শুকনো মরিচ পাঁচটির মতো দিবেন। তারপর দিবেন তিন চার টুকরোর মতো দাড়চিনি। এরপর চার পাঁচটির মতো সাদা এলাচ এড করবেন। কালো এলাচ দিয়ে দিবেন দুইটির মতো। তারপর তেজপাতা এবং এলাচগুলো দেওয়ার সময় একটু থিতু করে নিবেন এবং এতে সুঘ্রাণ বেরিয়ে আসবে।

আমের আচারের মসলা
ভাজার আগে এবং পরে

এবার চুলোর আঁচটা কম রেখে ভাজবেন। হাই হিটে ভাজবেন না কারণ এতে করে মসলাগুলো পুড়ে যাবে। শুকনো মরিচটা হালকা একটু লাল হয়ে আসা পর্যন্ত এটাকে ভেজে নিবেন।

ধাপ-৩: আমকে সেদ্ধ করে টাইট করে আনা

এবার কেটে রাখা আমগুলো মসলায় এড করে মিক্স করে দিবেন। এক্ষেত্রে আমগুলো আলাদাভাবে সেদ্ধ করার তারপর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রান্না করতে করতেই সেদ্ধ হয়ে যাবে। তারপর দিয়ে দিবেন চিনি। এক্ষেত্রে আমি তিন কাপ চিনি দিয়ে দিলাম। এতে করে মিষ্টিটা একদম পারফেক্ট থাকবে। এবার মিক্স করে নিবেন। আচারটা হবে একটু টক, একটু ঝাল এবং একটু মিষ্টি। এই পর্যায়ে চুলার আঁচটা থাকবে একদম হাই। হাই হিটে রেখে নেড়েচেড়ে চিনি গলে যাওয়া পর্যন্ত জাল করতে থাকবেন। চিনি গলে যাওয়ার পর এটা লিকুইড হয়ে আসবে। যে পর্যায়ে লিকুইড হয়ে আসবে তারপর ঢাকনা ঢেকে দিয়ে এটাকে সিদ্ধ হতে দিতে হবে।

আচারের জন্য সেদ্ধ হওয়া আম
গলে যাওয়া আম
সেদ্ধ হওয়ার পর আমগুলো গলে যাবে। এবার গলে যাওয়া আমগুলো সম্পূর্ণ টাইট হয়ে আসা পর্যন্ত অর্থাৎ একটু গ্রেভি টাইপ হয়ে আসা পর্যন্ত অনবরত নেড়েচেড়ে জ্বাল করতে থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন আচারটা পুড়ে না যায়। পুড়ে গেলে টেস্টটা নষ্ট হয়ে যাবে।তবে লিকুইড থাকাও চলবে না। লিকুইড থাকলে আচার নষ্ট হয়ে যাবে। একদম সব পানি টেনে নিতে হবে। সুন্দর একটা কালার চলে আসলে এবার চুলাটা বন্ধ করে দিবেন।

সম্পূর্ণ গলে টাইট হয়ে আসা আম
এভাবে টাইট হয়ে আসবে

ধাপ-৪: ধনিয়া এবং জিরার গুঁড়া যোগ করা

চুলা বন্ধ করে দিয়ে এড করতে হবে ভাজা ধনিয়া এবং ভাজা জিড়ার গুড়া। এখানে জিড়ার গুড়া এবং ধনিয়া তিন টেবিল চামচ মতো হবে। এবার এগুলো এড করে মিশ্রণটাকে ঠান্ডা হতে দিতে হবে। খবরদার এখন জ্বাল দেওয়া যাবে না। না হয় পুড়ে যাবে। এবার এটি চুলা থেকে নামিয়ে এক জায়গায় রেখে দিবেন। 

ধাপ-৫: আমের আচার রেসিপির মসলা তৈরি

এবার আসল কাজ। আপনাকে আচারের মসলা তৈরি করতে হবে। একটি কড়াই বা ফ্রাই প্যানে নিয়ে নিবেন এক কাপ সরিষার তেল। দিয়ে দিবেন এক চা চামচ পাঁচফোড়ন। দিয়ে হালকা একটু নেড়ে চেড়ে দিবেন। চুলার আঁচ কিন্তু কম থাকবে। এড করে দিবেন রসুন কুঁচি হাফ কাপ। তারপর চুলাটা রাখবেন মিডিয়াম আঁচে। মিডিয়াম আঁচে রাখার কারণ হলো আপনি যেহেতু এটা সরিষার তেলে ভাজছেন তাই যথেষ্ট ফেনা হবে। আপনি বুঝতে পারবেন না মসলা হয়ে এসেছে কিনা। তাই মিডিয়াম আঁচে রাখাই ভালো।

রসুনটা হালকা ব্রাউন হয়ে আসার পর অর্থাৎ নিচ থেকে নিয়ে একটু দেখবেন, তারপর একটু ভিনেগার এড করবেন আধা কাপ যাতে রসুনটা পুড়ে না যায়। 

এখন দিতে হবে এক টেবিল চামচ পাঁচফোড়ন এবং এক টেবিল চামচ সরিষা। দুটোই মিক্স করে হালকা একটু পানি দিয়ে বেটে নিয়ে তারপর দিতে হবে। এটা কিন্তু ভাজা নয়। এবার কিছুক্ষণ একটু নেড়েচেড়ে দিলে দেখবেন ফেনাটা চলে গেছে।

এখন দিবেন দুই তিন টুকরো দাড়চিনি। মরিচের গুঁড়া এক চা-চামচ দিবেন। ধনিয়ার গুঁড়া হাফ চা-চামচ। হলুদের গুঁড়া কোয়ার্টার চা-চামচ। অর্থাৎ এক চামচের তিন ভাগের এক ভাগ। লবণ স্বাদমতো। আমি হাফ চা-চামচ দিলাম। তারপর দিবেন আদা রসুন বাটা এক চা-চামচ। এখন মসলাটাকে ভালোভাবে কষিয়ে নিতে হবে। এবার ঝাল কম হয়েছে মনে হলে আর এক চামচ মরিচের গুঁড়া যোগ করতে হবে। এবার আমি আরেকটু ভিনেগার দিলাম।

এবার আরেকটু মসলাটাকে কষালাম। মসলাটা হবে ঠিক নিচের ইমেজের মতো। 

আমের আচারের মসলা
আমের আচারের জন্য প্রস্তুতকৃত মসলা

মসলাটার কিন্তু আলাদা একটা ফ্লেভার আছে যার কারণে আচারটা খেতে অসম্ভব ভালো লাগবে। এবার আমার মসলাটা হয়ে এসেছে। এবার চুলাটা বন্ধ করে দিয়ে মসলাটাকে ঠান্ডা করে নিলাম। এভাবে মসলা তৈরি করে আচারে এড করলে আচারটা হবে অনেক মসলাদার।

আবার মসলাটা যখন আপনি বয়ামের নিচে এবং আচারের ওপরে দিবেন তখন আর আচার নষ্ট হবে না।

এখন আমার নামিয়ে রাখা আচারটাও এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমার আচারটি এখন পুরোপুরি ড্রাই। আচার নিচের ইমেজের মতো পুরোপুরি ড্রাই হলেই কেবল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারবেন।

এখন আমার নামিয়ে রাখা আচারটাও এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমার আচারটি এখন পুরোপুরি ড্রাই। আচার নিচের ইমেজের মতো পুরোপুরি ড্রাই হলেই কেবল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারবেন।

ধাপ-৬: বয়ামে সংরক্ষণ

বয়াম অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিবেন। প্রথমে হাতের তালুতে একটু কালি জিরা ডলে নিয়ে বয়ামে রাখবেন। এবার চার থেকে পাঁচটি শুকনো মরিচ মাঝখানে কেটে বয়ামে রাখলাম। এতে করে ঝালটা বেরিয়ে আসবে এবং শুকনো মরিচের বীজসহ এড করতে হবে। এটি একই সাথে সৌন্দর্য্য বর্ধক এবং মুখরোচকও। এবার এর উপর দিয়ে দিবেন সেই রান্না করে রাখা আচারের মসলার অর্ধেক (বাকি অর্ধেক অন্য কাজে লাগবে)।

এর উপর এবার হালকা হাতে আচারগুলো দিয়ে দিবেন। এবার এর উপর আবার আচারের মসলাগুলোর বাকি অর্ধেক দিয়ে দিবেন। এভাবে করে সাজিয়ে ফ্রিজে রাখলে এই আচার আপনারা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে খেতে পারবেন, আচার নষ্ট হবে না। তবে ফ্রিজে না রেখে নরমালি কোথাও রাখলে মাঝে মাঝে দুই একবার গরম করে রাখতে পারেন, এতে করে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আর থাকবে না। তবে এমনভাবে তেল মসলাগুলো দিবেন যেন বয়ামের কোন অংশ খালি না থাকে। সব জায়গায় যেন মসলাগুলো ঢুকে থাকে। কারণ এই তেলমসলাগুলোর সাথেই ভিনেগার থাকে যার কারণে আচার নষ্ট হবে না।

বয়ামে মসলা মিশ্রিত আমের আচার

প্রথম ছবিতে বয়ামের নিচে কালি জিরা এবং শুকনো মরিচের সাথে অর্ধেক মসলা দিয়েছি, দ্বিতীয় ছবিতে এর উপর আচারগুলো রেখেছি, তৃতীয় ছবিতে আচারের ওপর আরেক দফা মসলা দিয়েছি, চতুর্থটিতে মসলার উপর আবারো সামান্য কিছু কালি জিরা এবং শুকনো মরিচ যোগ করেছি

এখন আরেকটু কালি জিরা এবং শুকনো মরিচ এর উপরে ছিটিয়ে দিবেন। এতে করে খেতে এবং দেখতেও সুন্দর লাগবে। আবার আপনার আমের আচারে নিচের থেকেও ফাঙ্গাস জমবে না এবং উপর থেকেও না।

তবে বাসায় এই আচার তৈরি করার পর বেশিদিন যায় নি। অর্থাৎ কয়েক দিনেই আচারগুলো সবাই মিলে খেয়ে শেষ করে দিয়েছি। আপনারা চাইলে বেশি করে বানাতে পারেন দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার জন্য। 

ব্যাস, হয়ে গেল আপনার বহুল আকাঙ্খিত আমের আচার রেসিপি। কমেন্ট বক্সে জানাবেন কেমন হয়েছে আপনার আমের আচার

আপনি চাইলে নিচের আর্টিকেলটি পড়ে সেরা স্বাদের গরুর মাংসের কালা ভুনা করে খেতে পারেন-
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url