প্লাস্টিক বর্জ্য যেভাবে বিশ্বকে ধ্বংস করছে

মানবজাতির ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য। ইউনেস্কোর মতে প্রতি বছর ৮ - ১০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। এই আর্টিকেলে মরণঘাতী প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়েই আলজাজিরার একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হবে। সারাবিশ্বের প্লাস্টিক ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যে সমুদ্র ভরপুর

প্রতিবছর প্রায় ৪০০ মিলিয়নের মতো প্লাস্টিকজাত পণ্য সারা বিশ্বে উৎপাদন করা হয়। তার মধ্য থেকে অর্ধেক বিভিন্ন প্যাকেটজাত, কাপ, শপিং ব্যাগ ইত্যাদি সিঙ্গেল ইউজের জন্য ব্যবহার করা হয়। এসব প্লাস্টিকের মধ্য থেকে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন টনের চূড়ান্ত পরিণতি শেষ হয় সমুদ্রে নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। যদি এ সমস্ত প্লাস্টিক বর্জ্য চ্যাপ্টা করে কোন জায়গায় রাখা হয় তাহলে প্রায় ১১০০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা তথা কাতার, জামাইকা বা বাহামাসের মতো দেশ দখল করা যাবে। এই হিসেবে ধরলে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জমে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায় ৫,৫০,০০০ এর মতো জায়গা দখল করবে যা ফ্রান্স, থাইল্যান্ড বা ইউক্রেনের মতো দেশের সমান।

এমন পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতিসংঘ প্রতি বছর ৮ জুনকে বিশ্ব সমুদ্র দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

যেভাবে সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের চূড়ান্ত পরিণতি হয় 

সমুদ্রের মোট সামুদ্রিক বর্জ্যের ৮০ পার্সেন্ট হলো সমুদ্রের ওপর ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য। অনুপযুক্ত এবং খুবই বাজে ধরনের নিষ্কাশন ব্যাবস্থার মাধ্যমেই প্রায় অধিকাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদী হয়ে স্রোতের মাধ্যমে সমুদ্রে এসে পড়ে। শিপ এবং ফিশিং বোটের প্লাস্টিক বর্জ্যও প্রায় সমুদ্রে এসে পড়ে কখনো বা মাছ ধরার জাল বা অন্যান্য মেরিন ইকুইপমেন্টের আকারে।

অন্যদিকে প্লাস্টিক ব্যাগ, ছোট ছোট কনটেইনার, বিভিন্ন ছোট প্লাস্টিকজাত দ্রব্য মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে সমুদ্রে ভিন্ন ধরনের এবং আরো ক্ষতিকর দূষণ ঘটায়। কারণ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণি মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো গ্রহণ করার কারণে মারাত্মক জীবনঝুকিতে পড়ে যায়। আজ প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন থেকে ৭০ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান। বিভিন্ন গবেষণা বলে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক লিভার, কিডনি, পাকস্থলির প্রদাহ এবং দেহের সেলুলার ডেমেজের জন্য দায়ি।অনেক সময় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি মিউনিসিপালিটির বিশুদ্ধ পানি পরিবহন লাইনে ঢুকে জনস্বাস্থ্যের ব্যাঘাতের কারণ হয়।

প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সমুদ্রে আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ হয়ে সেখানে থাকা বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণির মাধ্যমে অকল্পনীয় মাত্রায় শোষিত হয়। কিন্তু সমস্যার বিষয় হলো এ সমস্ত ছোট ছোট প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোতে বিভিন্ন বিষাক্ত ক্যামিক্যাল থাকে যা মানবদেহের বা বিভিন্ন প্রাণিদেহের হরমোনের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়।

সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের জন্য কোন দেশ সবচেয়ে বেশি দায়ী?

২০২১ সালে প্রকাশ হওয়া সায়েন্স এডভান্স রিসার্চের এক আর্টিকেলে দেখা যায়, সমুদ্রের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৮০ শতাংশই আসে এশিয়া থেকে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন (৩৬.৪%) সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারপর যথাক্রমে ইন্ডিয়া (১২.৯%), মালয়েশিয়া (৭.৫%), চায়না (৭.২%) এবং ইন্দোনেশিয়া (৫.৮%)। অবশ্য এই এমাউন্টের মধ্যে রপ্তানি হওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো নেই যাদের সমুদ্রে আসার সম্ভাবনা প্রবল।

পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক এত ক্ষতিকর কেন ?

প্লাস্টিক হলো সংশ্লেষধর্মী পদার্থ যা পলিমার থেকে প্রস্তুত করা হয়। পলিমার হলো বিভিন্ন অণু বা পরমাণুর জোটবদ্ধ লম্বা শিকল। এ সমস্ত পলিমারগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাস বা পেট্রোলিয়াম থেকে উদ্ভূত হয়। সমস্যা হলো এসব পদার্থ পরিবেশে বিয়োজিত হয় না , হাজার বছর ধরে থেকে পরিবেশের পলিউশনের কারণ হয়।

প্লাস্টিক এক দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রের উপর ভেসে বেড়ায়। পরিশেষে তারা নিমজ্জিত হয়ে সমুদ্রের তলায় গিয়ে ঠেকে। এভাবে সমুদ্রের নিম্নতলে গিয়ে মারাত্মক সামুদ্রিক বিপর্যয়ের কারণ হয় প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো।

অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং হতাশার বিষয় হলো, সমুদ্রের ওপর বিশাল আকারে ভেসে বেড়ানো প্লাস্টিক গুলো সমুদ্রে জমে থাকা প্লাস্টিকের মাত্র এক পার্সেন্ট। আরো ৯৯% সমুদ্রের গভীরে আছে।

এশিয়া এবং আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্লাস্টিক দূষণ মারাত্মক আকারে দেখা দিয়েছে। তবে উন্নত দেশ যেখানে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং রেট কম সেখানেও দূষণ দেখা দিয়েছে। অবশ্য বৃহৎ পর্যায়ে প্লাস্টিক কালেক্ট করার ক্ষেত্রেও সেসব দেশে সীমাবদ্ধতা দৃশ্যমান। বিশ্বে প্লাস্টিকের পরিমাণ এত বেশি বেড়েছে যে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ ছাড়া উপায় নেই।

এভাবে চলতে থাকলে যা ঘটবে

এক শতকেরও বেশি সময় ধরে প্লাস্টিক জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন খুব দ্রুত বেড়েছে। এই আধুনিক যুগে এসে প্লাস্টিক ছাড়া জীবন কল্পনা করা যাচ্ছে না। চিকিৎসাশাস্ত্রে জীবন-রক্ষাকারী বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে প্লাস্টিক প্রায় বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, মহাশূন্যে ভ্রমণকে সম্ভব করেছে ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদানে অবদান রাখার পরেও প্লাস্টিককে ডিজেস্টার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট -

বিশ্বের মোট প্লাস্টিকের অর্ধেক উৎপাদন করা হয়েছে গত ১৫ বছরে।

প্লাস্টিক উৎপাদনের মাত্রা কতটা তীব্র তা জানা যাবে একটি পরিসংখ্যানে। যেমন ১৯৫০ সালে সারা বিশ্বে মোট প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে ২.৩ মিলিয়ন টন। ২০১৫ সালে উৎপাদনের মাত্রা এসে দাড়ায় ৪৪৮ মিলিয়ন টনে।

প্রত্যেক বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টনের মতো প্লাস্টিক বর্জ্য উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়।

প্লাস্টিক পণ্যকে আরো শক্ত এবং নমনীয় করার জন্য কিছু অতিরিক্ত পদার্থ প্লাস্টিকে সংযোজন করা হয়। আর তাতেই এসব প্লাস্টিক পরিবেশে মিশতে প্রায় ৪০০ বছরের মতো লেগে যায়।

যেভাবে প্লাস্টিক বিশ্বকে ঘিরে আছে

জমি থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সাগরে গিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে পরিবাহক হিসেবে কাজ করে বড় বড় নদীগুলো। প্রথমে সমুদ্রে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য তীরবর্তী এলাকায় থাকলেও পরে ঢেউয়ের মাধ্যমে চলে যায় গোটা সমুদ্রে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url