দিরিলিস আরতুগ্রোল--মুসলিম বিশ্বের সোনালী অতীত
লিবিয়ার এক কিংবদন্তি মহানায়ক,ইতালীর উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক সংগ্রামী সফল বিপ্লবের কান্ডারি যাকে নিয়ে লিবিয়ার তৎকালীন সামরিক একনায়ক মোয়াম্মার গাদ্দাফির অর্থায়নে এবং মোস্তফা আখ্খাদের পরিচালনায় একটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছিল যার নাম 'মরুভূমির সিংহ'।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত এই সিনেমার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে কাশ্মীর থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রামীরা 'মুখতার' নামের একটি নামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহন করেছে।যে একজন শিক্ষক কিন্তু পরবর্তীতে একজন ইতালীয় উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কমান্ডার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে যান।
"আমরা আল্লাহর সাহায্যে তোমাদের বিরুদ্ধে বিশ বছর যাবৎ রুখে দাঁড়িয়েছি এবং ভবিষ্যতেও সেই আল্লাহর সাহায্যে তোমাদের শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব।"এই কথাটি এক ইতালীয়ের কানে বিপ্লবী মরুভূমির সিংহ খ্যাত 'উমর মুখতার' তুলে দিয়েছিলেন। ইতালির ট্যাংক এবং মেশিন গান সজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাদের ছিল উত্তর আফ্রিকায় লুটতরাজ চালানোর অভিজ্ঞতা সেই ইতালীয় সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখতার মাত্র একশ অশ্বারোহী রাইফেলসজ্জিত বেদুইন সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল।মুখতার ইসলামের যুদ্ধনীতিকে মেনে চলত যেই নীতিতে শত্রুর মর্যাদাও অন্তর্ভুক্ত।২০০৯ সালে ইতালি এই সিনেমাকে নিষিদ্ধ করে।বিপ্লবী সেনাপতি মোখতার ছিলেন একাধারে একজন স্কলার,সুফি এবং একজন যোদ্ধা। হযরত মুহাম্মদ (স:) এর আপন চাচাতো ভাই এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) এর যুদ্ধ আদর্শ ছিল ইতালীয় উপনিবেশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা মোখতারের আদর্শ।মোখতার তাঁর সাহসের জন্য মরুভূমির সিংহ নামে পরিচিত ছিলেন।হযরত আলীকে প্রিয়নবী 'আসাদুল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহর সিংহ উপাধি দিয়েছিলেন।ণবৈ সৈই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন মতে,সমালোচক ড্রিউ মিডলটন মরুভূমির সিংহ খ্যাত মোখতারের চরিত্রে অভিনয়কৃত অলিভার রিড এবং জন জিলগার্ড এর অভিনয়ের সূক্ষ্মতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল এবং ইতালিয়ানদেরকে তাদের প্রকৃত চরিত্র থেকেও বেশি হিংসাত্মক রুপে দেখানো হয়েছিল।লিবিয়ায় ইতালিয়ার ক্যাম্পেইন একটি লাগামহীন সাম্রাজ্যবাদেরই উদাহরণ। কিন্তু কিছু দর্শক মনে করেন আরবদের একটি প্রোপাগান্ডা রূপে। কারণ সিনেমাটির পরিচালক নিজেই আরব ছিলেন।
কতৃত্ববাদী লিবিয় সরকারের এক দালাল লিবিয়ান মোখতারকে বলেছিল তাদের কতৃত্ব মেনে নিতে। কিন্তু মোখতার উত্তরে বলেছিল "তারা আমাদের দেশ যদি দিনে কেড়ে নেয় তাহলে আমরা আল্লাহর সাহায্যে রাতে তা আবার ফিরিয়ে আনব। ঐই দালাল আরো বলেছিল তাদের ধাতুর অস্ত্রের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিরোধ করার মত কোন অস্ত্র নেই, বিপরীতে যা আছে তা হল রক্ত।
হলিউড এবং মুসলিম
বিশ শতকের কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে লিবিয়ার সিংহ খ্যাত মোখতার ছিল এক জ্বলন্ত প্রতীক যে পশ্চিমাদের তথাকথিত সভ্যতাকে পদদলিত করেছিল। শুধুমাত্র লিবিয়ারই একজন নায়ক নন, তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে উমর মোখতার একজন জীবন্ত কিংবদন্তি যে বিশ বছর যাবৎ ইতালির বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে এক সফল বিপ্লব পরিচালনা করেছে।
"এটি আল্লাহর কাছ থেকে আসা আমাদের উপর পবিত্র দায়িত্ব যারা আমাদের ঘর থেকে আমাদের বের করেছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো"বিপ্লবী উমর মোখতার। যাই হোক, এভাবে মূলধারার সিনেমাগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তথা মুসলিম জাতির কিংবদন্তি চরিত্রদের তুলে ধরে। ১৯৮০ সালে স্নায়ু যুদ্ধ শেষের দিকে মার্কিনিরা সোভিয়েতদের কাছ থেকে মোটামোটিভাভে পরাজয় মেনে নেয় এবং একই সাথে বাদামী মুসলমানদের কাছ থেকেও। মূলত সেই সময়টা থেকেই মাথায় রোমাল বাঁধা মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তকমা দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে রিলিজ হওয়া সিনেমা যেমন রেম্বো-৩(১৯৮৮),ট্রু লাইস(১৯৯৪) এবং এক্সিকিউটিভ ডিসিশন(১৯৯৮) এর মত মুভিগুলো মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই তকমাকে আরও গভীরে নিয়ে যায়।সেই সময়ের মুসলিম চরিত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষাকারী মুভির সংখ্যা খুবই কম ছিল। যেমন: ম্যালকম এক্স(১৯৯২) এবং আলী(২০০১)। এসব মুভি ছিল মূলত আমেরিকানদের ধর্মীয় চেতনার তথ্যচিত্র নিয়ে। যাদের ধর্মীয় পরিচিতি ধ্বংসের মুখে ছিল এবং তা এখনও পর্যন্ত চলমান।
১/১১ এর পরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সংস্কৃতি যুদ্ধ শুরু করেছিল পশ্চিমারা। কিছু প্রতারণামূলক কারণ দেখিয়ে পশ্চিমারা মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানে নিষ্ঠুর আক্রমণ পরিচালনা করে। যদিও মুজাহিদরা পশ্চিমা কুকুরগুলোকে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য করেছে। কিশোর কিশোরীরা যেসব ভিডিও গেম খেলে সেখানে দেখা যায় মার্কিন ড্রোনগুলো দিয়ে তারা পাকিস্তান,সিরিয়া,ইরান প্রভৃতি মুসলিম দেশগুলোর উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে ভার্চুয়ালি মুসলিম বিরোধী হামলার তথা মুসলমানদের জীবন কিভাবে কেড়ে নিতে হয় তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ইতালিয়ান জান্তা উমর মোখতারকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার পরবর্তী উমর মোখতারের বক্তব্য ছিল, " আমরা কখনোই আত্মসমর্পণ করব না।হয় জয়,না হয় মৃত্যু। এই দুটির মধ্যে যেকোন একটি হবে। এই সংগ্রাম কখনো শেষ হবে না।আমরা না পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তোমরা তোমাদের বিরুদ্ধে ময়দানে দেখতে পাবে। তারা না পারলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তোমরা মোকাবেলায় প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে। এটি কখনোই শেষ হবে না।"
আর্তুগ্রোল: এক কিংবদন্তীর পুনরুত্থান
২০১৪ সালে ডিসেম্বর মাসে তুরস্কে 'ডিজি' নামের একটি টিভি শো সম্প্রচারিত হয় টিআরটি-১ চ্যানেলে। পরিচালক মেহমেত বোজাকের পরিচালনায় সিরিজটি কায়ী নামে পরিচিত তুর্কি উপজাতিরা যারা মধ্য এশিয়ার প্রান্তরে বসবাস করত তাদের নিয়ে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যাত্রা। উসমানীয় সাম্রাজ্যে তথা তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার যাত্রাটি শুরু হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে যে যাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রথমে তুর্কি বীর আর্তুগ্রোল গাজী। কায়ী গোষ্ঠী প্রচন্ড শীতে খাদ্যভাবে ভোগত,যারা ছিল যাযাবর। তাছাড়া খ্রিস্টান ক্রুসেডার এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের শিকার তারা প্রায়ই হত।সে সময়ের তথাকথিত মুসলিম সাম্রাজ্য যেমন সেলজুক এবং আইয়ুবীরা বিভক্ত ছিল। সুতরাং প্রয়োজনের তাগিদেই সারা বিশ্বের মুসলমানদের এক করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই স্বপ্নকেই সাথে নিয়ে সুলাইমান শাহের ছেলে আর্তুগ্রোল গাজী তুর্কমেন বসতিগুলোর জন্য স্থায়ী ঘর তৈরি করতে সমর্থ হয়।আর্তুগ্রোল গাজী এই পবিত্র লক্ষ্য পূরণে আনাতোলিয়ার দিকে তার ঘোড়াকে ছুটিয়েছিল।এই বৃহৎ দ্বীপটি বর্তমানে আধুনিক তুরস্কের মূল গঠন বা ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।সেই সময়কার মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত এলাকার অধিকারী ছিল সেলজুক সাম্রাজ্য যারা ক্রমাগত ক্রুসেড বাইজানটাইন সাম্রাজ্য এবং বর্বর মোঙ্গলদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছিল। সুবিশাল সেলজুক সাম্রাজ্যের মধ্যে রোমের পাশাপাশি যে এলাকা সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও বিচ্ছিন্ন ছিল,দিরিলিস আর্তুগ্রোলের বেশিরভাগ অ্যাকশনই সেখানে সংঘটিত হয়েছে।
আরতুগ্রোল এবং তার আল্প নামে পরিচিত চৌকষ যোদ্ধারা টেম্পলারদের সাথে,বাইজানটাইনের সাথে, মোঙ্গলদের সাথে এমনকি তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা খোদ বিশ্বাসঘাতকদের সাথে লড়াই করে আনাতোলিয়ায় তাদের স্থায়ীত্ব গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল।
শীঘ্রই আর্তুগ্রোল বিভিন্ন তুর্কমেন বসতিগুলোকে একত্রিত করতে সমর্থ হন এবং তুর্কীদের প্রধান সেনাপতিতে পরিণত হন।রোমের সুলতানাতের সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে তুর্কি সুলতানাতের সূর্যের উদয় শুরু হয়।তার সাহস,যোগ্য নেতৃত্ব এবং কার্যকলাপ তুর্কীদের একটি নতুন সাম্রাজ্য গঠনের পথকে সুগম করে দেয়।আর্তুগ্রোলের উত্তরাধিকারী সর্বোপরি তার কনিষ্ঠ পুত্র উসমান অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
দীর্ঘ পাঁচটি সিজনের পর দিরিলিস আর্তুগ্রোল ২০১৯ সালে সমাপ্ত হয়েছে।প্রত্যেক সিজনে দুই ঘন্টার করে ত্রিশটি পর্ব রয়েছে সর্বোপরি ১৫০ টি ফিল্ম বলা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে নেটফ্লিক্সে প্রকাশের সময় প্রত্যেক সিজনের পর্বগুলোকে চল্লিশ মিনিট করে আশিটি পর্বে প্রচার করা হয়।দিরিলিস আর্তুগ্রোল একটি ম্যারাথন(দীর্ঘসময়ী) প্রচেষ্টা।প্রত্যেকটি সিজনেই রয়েছে চরিত্রগুলোর মধ্যে উত্থান পতন, উসমানীয় সাম্রাজ্যের বাস্তব ইতিহাসমত তাদের মধ্যে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের দিরিলিস সিরিজে বিভিন্ন চরিত্র দিয়ে উপস্থাপন,সেই সাথে রয়েছে নিজস্ব ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড, ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো চরিত্রের উত্থান বা পতনের সময় মিউজিক্যাল সাউন্ডে তাদের বেঁচে থাকার সময় তেজস্বী ঘটনাগুলো গল্প আকারে বলা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দৃশ্যগুলোকে চিত্রায়িত করা ইত্যাদি।'মরুভূমির সিংহ' চলচ্চিত্রের মতোই মুসলিম সুলতানাতের শেষ ইসলামী সাম্রাজ্য উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস,আদর্শ এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ বিষয়ক এই টিভি শো। মুসলমানদের বাস্তব এবং চিন্তার জগতে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসঘাতকদের দেখতে পায়, তাদের কিংবদন্তিদের দেখতে পায় এমনকি তাদের শত্রুদেরকেও। কিন্তু ইসলাম বিরোধীদের কাছ থেকে মুসলমানরা শুধু ব্যঙ্গচিত্রই উপহার পায়।দিরিলিস আরতুগ্রোল অতীতের বিভিন্ন বর্বর শক্তিকে ঠেকিয়ে দিয়ে একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর একটি সাম্রাজ্য গড়নের ইতিহাস।সেটা হল অটোম্যান সাম্রাজ্য। এখানে প্রতিরোধ এবং বিজয়কেই মুখ্যভাবে দেখানো হয়েছে। তুরস্কের বর্তমানের খুবই প্রভাবশালী এবং কতৃত্বময়ী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেফ এরদোগান এবং তুরস্কের শাসন ক্ষমতায় থাকা জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট বা একে পার্টিরও এতে সমর্থন আছে।এই সিরিজের মাধ্যমে তুরস্কের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় একে পার্টির সমর্থন সন্দেহাতীতভাবে বেড়েছে।
একসময়কার সেক্যুলার মুসলিম দেশ তুরস্কে এই সিরিজ দ্বারা ইসলামিকীকরণের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা তুরস্কের স্যকুলারিস্টরা ভাবতেও পারে নি। তুরস্কের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর প্রভাব একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করবে আশা করা যায়। যদিও এরদোগানের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ভাবছে এটিকে এরদোগানের একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল হিসেবে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল সিরিজটি নিয়ে একটি চমৎকার দর্শন তৈরি হয়েছে।সিরিজটিকে নব্য উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থানের রূপরেখা হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।এমনকি এর অ্যাক্টর এবং প্রডিউসাররা তুরস্কের মানুষের কল্পনাকে পাল্টে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া,মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বেশির ভাগ মুসলমানদের অন্তরে সিরিজটি একটি অণুরনন সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সীমান্ত পেরিয়ে বিশ্বের প্রায় লক্ষ লক্ষ এই সিরিজটির ভক্ত তৈরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্রায় আধ-ডজন ভাষায় এটিকে অনুবাদ করা হয়েছে এবং বাহাত্তরটি দেশে এর সম্প্রচার হচ্ছে। ইংলিশ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান এবং অ্যারাবিক ভাষায়ও একে সম্প্রচার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী এবং এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ যে সিরিজটির এক্টরদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জিত হয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজার বাসিন্দাদের মধ্যে এটি সিরিজটি এতই জনপ্রিয় যে প্রায় সময় তারা সিরিজটির প্রিয় চরিত্রদের নাম উচ্চারণ করে এবং সিরিজটির যে থিম মিউজিক আছে তা সবসময় তারা উচ্চারণ করে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের বিয়েগুলো এই সিরিজে দেখানো অর্থাৎ তার্কিক স্টাইলেই হতে শুরু করেছে।কাশ্মীরে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের নাম রাখা হচ্ছে এরতুগ্রোল। আমেরিকার দুইজন ভক্ত আলাদাভাবে সিরিজটির জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী ছিল সোগুত।যেটি বর্তমানে পর্যটকদের আকর্ষণ এবং ইন্টারনেটে এটি একটি স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের আদালতে,হামিমাহ তোয়ান নামের একজন মহিলা যে ২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলার শহীদ একান্ন জনের মধ্যে একজন।সে এরতুগ্রোলকে তার ইমাম হিসেবে সম্বোধন করেছে।
সারা বিশ্বে দিরিলিস এরতুগ্রোলের জনপ্রিয়তা সাগরের ঢেউয়ের মতোই তুঙ্গে। ফাতিমা ভুট্টোর মতে,সারা বিশ্বের মুসলিম সাম্রাজ্য চিত্রণ এবং তার পবিত্র মূল্যটা সিরিজটির ভেতর ফুটে উঠেছে।সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রাইমটাইম টিভিতে সিরিজটির উর্দু ভার্সন প্রচারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মতে হলিউড এবং বলিউডের চেয়েও অনেক বেশি সুষ্ঠু সংস্কৃতিপূর্ণ এই সিরিজ।মে'র মাঝামাঝি সময়ে দিরিলিস আর্তুগ্রোলের উর্দু ভার্সন ইউটিউবের সাবস্ক্রিপশন লেভেলকে ছাড়িয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরে তুর্কি সিরিজটির প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় সুদূরপ্রসারী ছড়িয়ে গিয়েছিল। দিরিলিস এরতুগ্রুল এর পাকিস্তানে জনপ্রিয়তার বিষয়টি বিবেচনায় আনলে সেখানকার এক জনপ্রিয় মুখ ইমাম সুলতানের মতে,'পাকিস্তানিদের মধ্যে দিরিলিস এরতুগ্রোল এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রয়েছে কারণ এখানে হাই রেজুলেশন টিভি চ্যানেলের অভাব, বাজেট সীমিত, এবং প্রোডিউসারদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, সীমিত বাজেট ইত্যাদি সব অপ্রতুলতা নিয়ে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দিরিলিস আরতুগ্রুল পিপাসার্ত মরুর বুকের বৃষ্টির মত আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়ায়, দিরিলিস এরতুগ্রুল এর সার্চ পরিসংখ্যান সেখানকার ফিল্ম এবং প্রখ্যাত টিভি পার্সোনালিটি শাহরুখ খান এবং এমন কি নরেন্দ্র মোদি কেও ছাড়িয়ে গেছে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্কের ইতিহাসে এরতুগ্রুল ছিল মোটামুটি জনপ্রিয় একটি চরিত্র। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে প্রান্তিক লেভেলে অবস্থান করছিল। কিন্তু ২০২০ সালে সারা বিশ্বজুড়ে ১০০ মিলিয়ন এর অধিক মানুষ দিরিলিস এরতুগ্রুল ছাড়া পৃথিবীকে কল্পনা করতে পারছেনা। দিরিলিস এরতুগ্রুল এবং তার জাতী অর্থাৎ কায়ী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তার এক দীর্ঘ পথ চলা এক দীর্ঘ সংগ্রাম, আবার সেই ঘটনার উপর ভিত্তি করে একুশ শতকে এসে তারই প্রামাণ্যচিত্রের উপর ভিত্তি করে টিভি সিরিজ নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ের অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন খুবই অপ্রতুল ছিল। কিন্তু দিরিলিস এরতুগ্রুল এবং তার অন্ত দর্শনগত মূল্য, তার একটা সুফি ভ্যালু এবং সেই সময়কার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কিভাবে তুর্কি জাতির দিন এবং রাত কেড়ে নিয়েছিল সেই সময়কার অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক অদ্ভুত এবং অপ্রতুল সমন্বয় করে দেখিয়েছে তুর্কি টিভি সিরিজ নির্মাতারা।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাস রচনাকালে ঐতিহাসিক পেরি অ্যান্ডারসনের মতে সেলজুক সম্রাট বসফরাসের চেয়ে নীলনদের দিকে বেশি আগ্রহী ছিল। তুর্কী উপজাতী গুলো যারা সীমান্তে বসবাস করছিল তারা পশ্চিম থেকে বাইজানটাইন এবং পূর্ব থেকে সর্বদা মোঙ্গলদের আক্রমণের শিকার হতো। এই সীমান্তের যোদ্ধারা অর্থাৎ তুর্কি উপজাতি গুলো যারা রীতিমতো লড়াই করে টিকে আছে তারা নিজেদের জন্য স্বাধীন ভূমির অভাব বোধ করতে থাকে। এমনকি সেই ভূমি কেমন হবে তা নির্ধারণেও তাদের নিজস্ব পছন্দ ছিল। তারা কোন অবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থানের বিরোধী ছিল।
দিরিলিস আর্তুগ্রোল সিরিজটিতে আর্তুগ্রোলের আধ্যাত্যিক নেতা ছিলেন সেই সময়কার আরবের আন্দালুসিয়ার প্রখ্যাত ইসলামিক পন্ডিত এবং আধ্যাত্মিক গুরু ইবনে আরাবি (১১৬৫-১২৪০)। তবে এই সিরিজটিতে বিশেষ করে বিষয়ের চেয়ে তত্ত্বেরই বেশি আধিক্য আছে।সিরিজটির সিজন-২ তে আর্তুগ্রোল দুশ্চরিত্র,দূর্ধর্ষ এবং হিংস্র নয়ান নামের এক মোঙ্গল কমান্ডার কতৃক আটক হন। দীর্ঘ সময় ধরে আর্তুগ্রোলের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।দয়াহীন নির্যাতনে আর্তুগ্রোল মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল।সেই রাতে আর্তুগ্রোলের জীবনে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে।
রাতে আরতুগ্রোলের বিশ্রামের এক পর্যায়ে ইবনে আরাবী আরতুগ্রোলের স্বপ্নে আসেন। তিনি আরতুগ্রোলকে পবিত্র কোরআন থেকে একটি ঘটনা বলেন যেখানে ইয়েমেনের একজন অত্যাচারী এবং সম্পদশালী বাদশাহকে সে এবং তার হস্তীবাহিনী সহ কিভাবে আল্লাহ সামান্য এক পাল পাখি দ্বারা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন সেই ঘটনার বর্ণনা। পাখিগুলো পবিত্র মক্কা নগরীকে রক্ষার জন্য সেই অত্যাচারী বাদশাহর অগ্রগামী সৈন্যের উপর পাথর নিক্ষেপ করে এবং তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। স্বপ্নে ইবনে আরাবী এরতুগ্রোলকে বলেন,'তুমি যখন দূর্বলতার শেষ সীমায় পৌছে যাবে তখন তুমি ভাবিও না যে এটি অনেক বড় এবং শক্তিশালী যা তোমার উপর জয়লাভ করবে।কে বিজয়ী হবে তা একমাত্র আল্লাহই নির্ধারণ করবেন।'
এরতুগ্রোল মুহূর্তে জেগে উঠে এবং আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন যে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যে সবার উপর ছায়া হিসেবে আল্লাহ আছেন।
সিরিজের শেষের দিকে এরতুগ্রোল একটি বাইজানটাইন দূর্গ দখল করেন। দূর্গ জয়ের পর তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি বিজয়ের অহংকার থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। পরবর্তীতে ইবনে আরাবী দূর্গটি পরিদর্শন করেন। তিনি এরতুগ্রোলকে দূর্গের বিজয় চিরস্থায়ী করার ব্যাপারে,দূর্গ পরিচালনার জন্য যোগ্য মেধার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন,ন্যায়বিচার এবং সকল ধর্মের প্রতি ন্যায্য হওয়ার উপদেশ দেন।
সিরিজটিতে উপস্থাপিত অমুসলিমদের প্রতি করা আচরণকে ইসলামী শাসন কেমন হতে পারে তার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইবনে আরাবী ছিলেন তুর্কিদের সুফি ঐতিহ্যের এক মূর্ত প্রতীক। ইবনে আরাবী একজন সাধক এবং একই সাথে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও পরিচিত। সে ছিল তখনকার সময়ের আল শেইখ আল-আকবর অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ শেইখ যে তার আধ্যাত্মিকতার জন্য আনাতোলিয়াকে বেছে নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাঁর সন্তান আকবরি চিন্তাধারার উপর একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।
অন্য কথায়,এরতুগ্রোল ইবনে আরাবীর কারণেই বুঝতে পেরেছিলেন একটি ভবিষ্যত ইসলামী রাষ্ট্রের রুপধারা কেমন হওয়া উচিত।